'দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত দুই ছেলে, স্ত্রী ও নাতির মৃত্যুর অনুমতি পত্র'।
মেহেরপুরের জেলা প্রশাসক বরাবর কম্পিউটারের টাইপ করে লেখা আবেদন পত্রটির বিষয়ের জায়গায় এমন লেখা দেখে যে কেউ আঁতকে উঠবেন।
গত বৃহস্পতিবার এই আবেদনপত্রটি পেয়ে ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক খায়রুল হাসানও আঁতকে উঠেছিলেন।
সঙ্গে সঙ্গেই তিনি যোগাযোগ করেছিলেন আবেদনকারী তোফাজ্জেল হোসেনের সঙ্গে।
মি. হোসেন, মেহেরপুর বাজারে একটি দোকানের মালিক ছিলেন। ভালোই ছিলেন।
কিন্তু সর্বস্ব তিনি খুইয়েছেন অসুস্থ দুই ছেলে আর নাতির পেছনে।
তারা পক্ষাঘাতগ্রস্ত। অচল-প্রায়।
দিনকে দিন তাদের অবস্থা খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছে।
চব্বিশ বছর বয়েসী বড় ছেলেটির বেঁচে থাকবার আশা ছেড়েই দিয়েছেন মি. হোসেন।
তবে ছোট ছেলেটি এবং নাতিটির অবস্থা অত খারাপ নয় বলে এখনো স্বপ্ন দেখেন তাদের বাঁচানোর।
সর্বশেষ বাজারের দোকানটি বেচে বড় ছেলে সবুরকে ভারতে নিয়ে গিয়েছিলেন।
সেখানকার
চিকিৎসকেরা জানিয়েছিল, সে বিরল এক ধরণের 'মাসকুল্যার ডিসট্রোফি' বা
মাংসপেশিতে পুষ্টির অভাবজনিত অসুখে আক্রান্ত এবং এর চিকিৎসা তাদের কাছে
নেই।
এরই মধ্যে চলার ক্ষমতা হারিয়েছে সবুর।
চলৎশক্তি হারানোর পথে রয়েছে তের বছর বয়েসী ছেলে রায়হানুল ও আট বছর বয়েসী নাতি সৌরভ।
ওদিকে স্ত্রীও মানসিক অসুখে আক্রান্ত।
ফলে অন্নসংস্থানের পাশাপাশি এদের দেখভালের কাজও করতে হচ্ছে মি. হোসেনকে।
এরকম
পরিস্থিতিতেই মি. হোসেন সরকারের কাছে আবেদন করে বলেছেন, হয় চিকিৎসার
ব্যবস্থা করুন নচেৎ তাদেরকে ঔষধ খাইয়ে মেরে ফেলার অনুমতি দিন।
বিবিসিকে
তোফাজ্জেল হোসেন বলছিলেন, "কি করব বলুন? বড়টাকে আজ চৌদ্দ বছর ধরে টেনে
নিয়ে বেড়াচ্ছি। আর পারছি না। সকলেই শয্যাগত হয়ে গেছে। আমরা আর কতদিন
টানবো বলেন? এছাড়াতো কোন বিকল্প পথ আমার আর নেই"।
ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক খায়রুল হাসান বলছেন, "চিঠি
পেয়ে তোফাজ্জেল হোসেনকে আমি ডেকে পাঠিয়েছি। তার সমস্যা শুনেছি। তার বাড়ি
গিয়ে পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখেও এসেছি"।
চিঠির বিষয়বস্তুতে
পরিবারের সদস্যদের মৃত্যু চাওয়ার কথা বললেও, মূলত তোফাজ্জেল হোসেন তাদের
চিকিৎসার জন্য সাহায্য চেয়েছেন উল্লেখ করে মি. হাসান বলছেন, "অত্যন্ত
আবেগপ্রবণ হয়ে তিনি এসব লিখেছেন"।
"সরকারি কর্মকর্তা হলেও আমিতো
একজন মানুষ! ওনার কান্নাকাটি দেখে, আমারও মনে হয়েছে ওনার জন্য আমার
ব্যক্তিগতভাবেও যদি কিছু করার থাকে সেটা করা উচিত"।
পরিস্থিতি বিচার
করে বিভাগীয় কমিশনারকে জানানো হয়েছে। তোফাজ্জেল হোসেনের ছেলে ও নাতিদের
চিকিৎসার কাগজপত্র সেখানে পাঠানো হচ্ছে। তাদের ব্যাপারে সরকারী তরফে কি
করণীয় আছে সেটা যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন মি. হাসান।
তবে তোফাজ্জেল হোসেনের জন্য সুখবর, তার এই আবেদনের খবর বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে।
বহু মানুষ তার খবর নিচ্ছেন এবং পাশে দাঁড়াতে চাইছেন।
বিদেশ থেকেও লোকজন ফোন করে তাদেরকে আর্থিক সহায়তা দিতে চাইছেন।
ভারপ্রাপ্ত
জেলা প্রশাসক তাকে পরামর্শ দিয়েছেন একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে, যাতে
সেই অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে হৃদয়বান মানুষেরা তাকে অর্থ সাহায্য দিতে পারেন।
জেলা প্রশাসন আর স্থানীয় সাংবাদিকদের দেয়া খবরাখবর বিশ্লেষণ করে
মনে হচ্ছে, আবেগী এই চিঠিতে চারিদিকে এতই সাড়া পড়ে গেছে যে, তোফাজ্জেল
হোসেন তার দুই ছেলে আর নাতির জন্য একটি শেষ চেষ্টা চালানোর সুযোগ হয়ত
পেয়েও যেতে পারেন।
এ যাত্রা হয়তো আর পরিবারের সদস্যদের ঔষধ খাইয়ে মেরে ফেলতে হচ্ছে না মি. হোসেনকে।
0 facebook: