Tuesday, January 9, 2018

মাদকের অপব্যবহার রোধ ও গণসচেতনা সৃষ্টি


মাদকের অপব্যবহার রোধ ও গণসচেতনা সৃষ্টি

মোহাম্মাদ শামসুল হুদা

মাদক ইংরেজী ‘ড্রাগ’  শব্দটি ইতালীয় মুল শব্দ ‘ড্রাগ’ থেকে এসেছে যার অর্থ ‘গাছ-গাছড়া থেকে আহরণ করা শুল্ক ঔষধি’। ড্রাগের বাংলা প্রতি শব্দ ভেষজ বা মাদক। বিশ্বস্বাস্থ্য প্রদত্ত সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, “মাদক হলো এমন বস্তু যা জীবন্ত জীব গ্রহণ করলে তার এক বা একাধিক কার্যকলাপের ঈষৎ পরিবর্তন ঘটায়। বাংলাদেশ মাদক উৎপাদনকারী দেশ নয়। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে অর্থাৎ দেশটি পূর্বদিকে গোল্ডে ট্রায়াং গেল (মায়ানমার, লাউস ও থাইল্যান্ড এই তিনটি সীমান্তের সংযোগস্থল), গোল্ডেন ক্রিসেন্ট (উত্তর ভারত, নেপাল ও ভূটান এই তিনটি দেশের সীমান্তের মিলনস্থল) এবং গোল্ডেন ওয়েজ (পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরান এই তিনটি দেশের সীমান্তের সন্ধিস্থল) তিন প্রধান মাদক উৎপাদনকারী বলয়ের মাঝখানে আমাদের দেশ অবিস্থত হওয়ায় ইউরোপীয় দেশসমূহ ও যুক্তরাষ্ট্রের মাদকাসক্তের চাহিদা মেটানোর জন্য আন্তর্জাতিক মাদক চোরাকারবারীরা বাংলাদেশকে ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। এখানে বহুকাল আগে থেকেই পপি ফুলের চাষ হয়ে আসছে। পপি ফুল হতে তৈরী হয় আফিম। আর এই আফিমই হচ্ছে বর্তমানের সর্বশ্রেষ্ঠ মাদকদ্রব্য হিরোইনের প্রধান উপাদান।
মাদকদ্রব্য হিসেবে যেসব চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলি হচ্ছে হেরোইন, কোকেন, চরস, আফিম, দেশী মদ বিদেশী মদ, ফেনসিডিল, প্যাথেডিন ও টিডিজেসিক ইনকেজশন, রেকটিফাইড স্পিরিট, ডিনেচার্ড স্পিরিট, মেথানল, বেলাডোনা, মৃত্যুসঞ্জীবনী, ভায়াগ্রা টেবলেট, সেনেগ্রা টেবলেট, তাড়ি, গাঁজা, ভাং, সিগারেট, বিড়ি, তামাক, গুল এবং বিভিন্ন রকম ঘুমের ঔষধ যথা-সিডাকহসিন, ভ্যালিয়াম, ফ্রিজিয়াম, রিলাকজেন, ইউনকটিন, ফুটুস, চরস, হাশিস, চান্ডু।
হেরোইন হচ্ছে বর্তমানে সর্বাপেক্ষা প্রাণঘাতি এবং ক্ষতিকারক মাদকদ্রব্য। ১৯৯৮ সালে জার্মান ভেজষবিদ হাইনরিশ ড্রেসার পাউডার সদৃশ্য এই বস্তুর নাম দেন হেরোইন।
বর্তমান বিশ্বে সর্বাধুনিক যে সমস্যাটি প্রতিটি মানুষের নিদ্রাকে হরণ করেছে তা হচ্ছে মাদকাসক্তি সমস্যা। যার সামাজিক প্রতিক্রিয়া এখন গোটা পৃথিবীর জন্য একটি দুরারোগ্য সংকট। ঘরে ঘরে পিতৃপুরুষ শুধু নিরুপায় দু:স্বপ্ন দেখছে- কখন তার নিষ্পাপ নিরীহ সন্তানটি এই গুপ্ত নেশাচক্রের শিকার হয়ে প্রতি মুহূর্তে তার এই আশংকা। স্থূল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হোস্টেল আর ঘরে বাইরে ছড়ানো আড্ডায় মাদক-দ্রব্যের ছোবল অপেক্ষা করছে। ফলে এই প্রজন্ম এখন বিপন্ন। মাদকদ্রব্যের করাল থাবায় সমস্ত বিশ্বে বাড়ছে অস্থিরতা, সীমাহীন দুর্ভোগ, আর পরিণাম এমন অবস্থায় দাড়িয়েছে যে, দেশে দেশে তখন জ্বলছে অশান্তির আগুন, চলছে রক্তপাত, বাড়ছে সন্ত্রাস।
মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার মানব শরীরে একটি দীর্ঘস্থায়ী বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে মানুষের শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক অবনতি ঘটায়। প্রাথমিক পর্যায়ে কিছুটা সুখবোধ জাগলেও আসক্ত ব্যক্তিক্রমে ক্রমে সমস্ত কর্মস্পৃহা হারিয়ে ফেলে জীবনীশক্তি, মস্তিষ্ক, ফুসফুস ও হৃৎপিন্ডের ক্ষতি হতে শুরু করে। ক্ষুধা, মন্দা, যকৃতির প্রদাহ, বিভিন্ন প্রকারের চর্ম ও যৌন রোগে আক্রান্ত, ঘুমের ব্যাঘাত, স্ট্রোক, চুলপড়া, চোখে ছানি পড়া, শ্বাসকষ্ট, পায়ের পচন, খাদ্যনালিতে ক্যান্সার হয়।
মাদকাসক্তির পরিবারের তথা সমাজের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। মাদকদ্রব্য ক্রয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করতে আসক্ত ব্যক্তি বিভিন্ন প্রকারের অবাঞ্ছিত, এমনকি অপরাধমূলক ক্রিয়াকলাপের লিপ্ত হয় এবং সামাজিক শান্তির সর্বনাশ করে। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়। বর্তমানে আমাদের দেশে বিশেষ করে শহর এলাকায় যে পরিমাণ খুন-খারাবি, রাহাজানি ইত্যাদি অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে তার এক উল্লেখযোগ্য অংশ মাদকাসক্ত ব্যক্তিগণ কর্তৃক সম্পন্ন হচ্ছে। মাদকদ্রব্য মানুষের বোধশক্তি কেড়ে  নেয়। নিজের ওপর  নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে মাদকসেবীরা।  মাদকদ্রব্যের ফলে একটি মানুষ তিলে তিলে নি:শেষ হয়ে যায়। মাদকাশক্তির ফলে আজ যুব সমাজ লক্ষহীন যুদ্ধ-বিগ্রহের চেয়েও এটা ভয়ংকর। কারণ যুদ্ধের মধ্যে একটি জাতিকে বা গোষ্ঠিকে ধ্বংস করতে চাইলেও একবারে নির্মূল করা সম্ভব নয় যা কিনা মাদকতার কারণে সম্ভব।
মাদকাসক্তির কারণ সম্পর্কে যে সমস্ত বিষয়ের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করা হয়ে থাকে তার মধ্যে অন্যতম হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব, পারিবারিক বন্ধনের অভাব, ব্যাপক বেকারত্ব, অধিক হতাশা, পিতামাতা এবং সামাজিক নিয়ন্ত্রণের অভাব, আর্থিক দৈন্য, নীতি ও আদর্শহীনতা, বড়দের প্রতি ছোটদের শ্রদ্ধাহীনতা, ব্যবসায় অধিক লাভের বাসনা, অত্যাধিক অর্থশালী হওয়ায়, আইনী দুর্বলতা, অবৈধ অর্থ উপার্জনের আধিক্য, অপরাধ প্রবণ, পাশ্চাত্য সংস্কৃতি, প্রেমে ব্যর্থতা, নানা অসামাজিক কাজ ইত্যাদি। আরও দেখা যায়, বর্তমানে আমাদের দেশে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে মাদকসক্তির প্রকোপ অপ্রতিরোধ গতিতে  বেড়ে চলেছে। এর কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয় সেশন জট, শিক্ষাঙ্গণের অস্থির পরিবেশ এবং শিক্ষাজীবন শেষে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা। তাছাড়া জনসাধারণের অসচেতনা এবং মাদকবিরোধী কর্মকান্ডে জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করতে ব্যর্থতা মাদকের ভয়াবহতা বৃদ্ধির একটি অন্যতম কারণ।
মাদকদ্রব্যের অপব্যবহারের সমস্যাটির সমাধান সম্পর্কে কতিপয় সুপারিশ করা যেতে পারে যাহা মাদকাসক্তির অনেকটা লাঘব হয়ে হবে।
১। পারিবারিক সচেতনতা ঃ যেসব পরিবারে কিশোর-কিশোরী এবং উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণী রয়েছে তাদের সমস্যাটি বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে। পারিবারিক অশান্তি, অভিবাবকের অযতœ অবহেলা ইত্যাদি কারণে হতাশাগ্রস্থ হওয়ায় সম্ভাবনা থাকলে পরিবারের সদস্যদের সচেতন থাকতে হবে।
২। শিক্ষাঙ্গনে শৃঙ্খলা ঃ বর্তমান শিক্ষাঙ্গণে তার অবসান করতে হবে এবং ছাত্র-ছাত্রীদের হতাশাগ্রস্থ থেকে একেবারেই অবসান করতে হবে। ছাত্র সমাজকে মাদকাসক্তদেরকে বিপুল অর্থ দিয়ে মাদক নামক। ‘বিষ’ না কিনে জ্ঞানের বাহক ‘বই’ কেনার পরামর্শ দিতে হবে। ছাত্র সমাজকে মাদকবিরোধী ‘বই’ এবং মহৎ ব্যক্তিদের জীবনী সংগ্রহ করে ।
পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায়- মহল্লায় পাঠাগার গড়ে তুলতে হবে। ইহাছাড়া মাদদ্রব্যের অপব্যবহার প্রতিরোধের একটি ভূমিকা হিসাবে ছাত্র সমাজ বিভিন্ন অন্ষ্ঠুানের মাধ্যমে মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্চার শ্লোগান তুলতে হবে। গণসচেতনতা, সামাজিক আন্দোলন বুলেটিন প্রকাশ, পোষ্টার ও স্টিকার বিতরণ করা, মাদকদ্রব্যের কুফল সম্পর্কে নির্মিত শট ফ্লিম, রচনা প্রতিযোগিতা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাদক বিরোধী কমিটি ও সচেতনামূলক সভা ইত্যাদি মাধ্যমে মাদক বিরোধী প্রচারণা চালু করা হবে।
৩। চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা ঃ খেলাধুলা এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রম সুস্বাস্থ্য এবং মানসিক বিকাশের সহায়ক। শিশু, কিশোর যুবক, যুবতীতের ক্রীড়া এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে উৎসাহিত করে যথাযথ চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে।
৪। বেকারত্ব রোধ ঃ বেকারত্ব মাদকাসক্তির একটি অন্যতম কারণ। সরকারী এবং বেসরকারী উভয় পর্যায়ে কমংসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে।
৫। মাদকাদ্রব্যের অপব্যবহার প্রতিরোধের জন্য সমাজকল্যাণমূলক কর্মসূচি, মাদক বিরোধী বই কেনায় পরামর্শ, অপসংস্কৃতির বিনাশ। নৈতিকতা সৃষ্টি করতে হবে। ইহা ছাড়া অসৎ সংগ, পরিহার, করতে ধর্মীয় মূল্যবোধ সৃষ্টি করতে হবে।
মাও সেতুং একবার বলেছিলেন, ‘মাছের পচন শুরু হয় মাথা হতে, জাতির  পচন শুরু হয় নেতা হতে।’ সত্যিই আজকের এই মাদকদ্রব্যের চরম অপব্যবহারের জন্য দায়ী মুষ্টিমেয় কিছু রাঘব বোয়াল যারা পরোক্ষ ভাবে ও দেশে মাদকদ্রব্যের ব্যবসা করে কালো টাকার পাহাড় গড়ছেন। কেননা কোনো বিশেষ প্রভাবশালী মহলের পৃষ্ঠপোষাকতা ছাড়া বড় ধরনের অপরাধ সংগঠিত হতে পারে না। ছাত্র সমাজকে সকল ভয়ভীতি কাটিয়ে সেইসব কালো টাকার অধিকারী প্রভাবশালী নেতা নাম ব্যক্তিদেরকে চিহ্নিত করতে হবে এবং তারা যেন হতাশার সুযোগ নিয়ে ছাত্র যুব তরুণদেরকে ব্যবহার করতে না পারে সে ব্যাপারে তাদের বিরুদ্ধে শক্ত প্রাচীর গড়ে তুলতে হবে।
নেশার প্রথম ধাপ হলো ধুমপান। আরো দেখা যায় গুলের ব্যবহার স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ধোয়াবিহীন তামাক পণ্য গুল নামক বিষ সেবন করে অজান্তেই মৃত্যুর দিকে ধাপিত হচ্ছে গুলাসক্তরা। বিড়ি, সিগারেটের চেয়ে গুল স্বাস্থ্যের জন্য অধিক ক্ষতিকর। একটি কথা দ্রুব সত্য তা হলো তামাক চাষাবাদে বেড়া দিতে হয় না, কেননা গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ, কুকুর গাঁধাও কোন পশুপাখি কেউ এটা খায় না। শুধু সৃষ্টির সেরা মানুষের তথা আনন্দের সাথে সেবন করে থাকে। সেজন্য সব ধরনের নেশা মাদকদ্রব্য সেবন করা আল-কুরআনের ৫টি আয়াতের মাধ্যমে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অর্থাৎ পবিত্র ধর্ম ইসলামে সব ধরনের মাদক দ্রব্যের ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে হারাম। হযরত ইবনে ওমর (রা) বলেছেন, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সব মাদকদ্রব্য মদের পর্যায়ভুক্ত এবং সব মদই হারাম। পার্থিব জীবনে যে মদ পানে অভ্যস্ত ছিল এবং তওবা না করে মারা যায়, পরলোকে সে জান্নাতি পানীয় থেকে বঞ্চিত থাকবে।
মাদকাসক্তরা পুলিশ বা আইন রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে নির্যাতনের শিকার হয় এবং কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়। ফলে তাদের সংশোধন হওয়ায় সুযোগ থাকে না। অথচ সরকার এবং বিভিন্ন এনজিও নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন চিকিৎসা কেন্দ্রে তাদের পাঠালে তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসার সুযোগ থাকে না।  সেজন্য তাদেরকে ঘৃণা, অবহেলা কিংবা দুরে ঠেলে না দিয়ে এবং সমাজে লজ্জায় বিষয় ভেবে বা গোপনে না রেখে তার যথাযথ চিকিৎসায় ব্যবস্থা করা পরিবারের দায়িত্ব। 



মোহাম্মদ শামসুল হুদা
 সিনিয়র সাংবাদিক





শেয়ার করুন

0 facebook: