Tuesday, July 3, 2018

দিনাজপুরের নিভৃত এলাকার বিনোদন স্পট স্বপ্নপুরী প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি



দিনাজপুরের নিভৃত এলাকার বিনোদন স্পট স্বপ্নপুরী প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি

এম এ আলম বাবলু,

আধুনিকতার সাথে তাল মিলাতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে মানুষের বিভিন্ন রকমের চাহিদা। এ চাহিদার একটি অংশ হচ্ছে বিনোদন। এমনি ধরণের একটি বিনোদনমূলক স্থান উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তম পিকনিক স্পট স্বপ্নপুরী। এখানে বেড়াতে আসলে বাংলাদেশটিকে দেখা যাবে। দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার কুশদহ ইউনিয়ন পরিষদের স্বাধীনতার পর থেকে লাগাতার চেয়ারম্যান, সৌন্দর্য্য পিপাসু, ভ্রমন বিলাসী, সুরশিল্পী এবং সাংস্কৃতিক ও প্রকৃতি প্রেমিক মোঃ দেলোয়ার হোসেন ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটি পিকনিক কর্ণার গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়ে ১৯৮৯ সালে কাজ শুরু করেন। তার পিতা ডাঃ আফতাব উদ্দিন আহম্মদ দীর্ঘ তিন দশক জুড়ে ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। জনাব হোসেনের এক মাত্র অনুজ সাবেক সাংসদ খ্যাতিমান কন্ঠ শিল্পী এবং চিত্র পরিচালক মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান ফিজু স্বপ্নপুরীর নির্মাণের উপদেষ্টা হিসাবে তার বিরাট ভূমিকা রয়েছে।                 দিনাজপুর জেলা সদর থেকে ৫২ কিলোমিটার এবং ফুলবাড়ী উপজেলা শহর থেকে ১২ কিলোমিটার পূর্বে নবাবগঞ্জ উপজেলার আফতাবগঞ্জ এলাকার খালিশপুর মৌজায় অবস্থিত প্রত্যন্ত পল্লী অঞ্চলের গহীন বনজঙ্গলে এবং বাপ দাদার গড়ে থাকা বিশাল মজা পুকুর সংস্কার করে ১ শ একর জমির উপর নির্মিত উত্তরবঙ্গের মনোরম ছিমছাম ভ্রমনে কেন্দ্র গড়ে উঠেছে মনকাড়া এই স্বপ্নপুরী পিকনিক কর্ণার। ১৯৯০ সাল থেকে যাত্রা শুরু করে স্বপ্নপুরী পিকনিক কর্ণারের। ুস্বপ্নপুরীপরিবার পরিজন, বন্ধু বান্ধব নিয়ে প্রাণ খুলে মনের অব্যক্ত কথা বলা চর্মচক্ষু দিয়ে ইপভোগ করা কোলাহল মুক্ত পরিবেশ নিদ্রা যাপনের এক অনন্য স্থান। এখানে একবার গেলে বার বার যেতে মন ছটফট করে। পাষাণ হৃদয়ের মানুষের মনও নরম হয়ে যায়। স্বপ্নপুরীতে ঢুকলেই মনে হয় মায়াবী স্বপ্নিল এক ভুবন।                 স্বপ্নপুরীর প্রবেশ দ্বারে দন্ডায়মান বিশাল আকৃতির দুটি পরীর প্রতিকৃতি। ওরা পর্যটকদের স্বাগত জানাতে সদা প্রস্তুত। এখানে রয়েছে একটি কৃত্রিম চিড়িয়াখানা। যার মধ্যে রয়েছে দেশি বিদেশী বিভিন্ন পশু পাখির অবিকল ভাস্কর্য এবং একটি কৃত্রিম পাহাড়। এই চিড়িয়াখানার সবচেয়ে আর্কষনীয় বস্তু হলো চারদিকে পানি ঘেরা ইট-সিমেন্টের তৈরী বাংলাদেশের একটি নিখুঁত মানচিত্র। এর আয়তন প্রায় ২৫০০ বর্গফুট।                 বিনোদন আমোদী সব বয়সীদের জন্যে এখানে নানা ধরণের উপকরণ রয়েছে। শিশুদের জন্যে রয়েছে শিশুপার্ক, দোলনা, চরকি, আলোকচিত্র প্রদর্শনী, বাইস্কোপ প্রভৃতি। বয়স্কদের জন্যে রয়েছে গার্ডেন রেস্তোরা। সবুজ দেবদারু গাছের ছায়ায় পাতা রয়েছে দুধ সাদা চেয়ার। বিশ্রামের ব্যবস্থায় আছে রেষ্ট হাউজ এবং বাংলো বাড়ী। এদের কয়েকটির মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষনীয় হলো ুনিশিপদ্ম                 বিস্তীর্ণ ঝিলের তীরে সদ্য ফুটন্ত গোলাপ বাগানের মাঝখানে সবুজ ঘাসের চাদরে স্থাপিত নিশিপদ্ম। কাঠ ও ইট-সিমেন্ট-এর তৈরী এ বাংলার গায়ে রয়েছে নিখুঁত কারুকার্য। হালকা গোলাপী রঙ এর আস্তরণে চোখ আটকে যায়। ওপরে ডিজাইন করা টিনের সেড এর সৌন্দর্য আরো বাড়িয়েছে। যেনো রূপালি মুকুট পরিহিতা এক রাজকন্যা সবাইকে নিরব অীভনন্দন জানাচ্ছে।                 পর্যটকদের প্যাটার্নেও গার্ডেন রয়েছে। কোনটায় গোলাপ, কোনটায় কচমচ। কোথাও রজনীগন্ধা, হাসনা হেনা, বাগান বিলাপস এবং নাম না জানা আরো অসংখ্য ফুলের সমারোহ। গার্ডেনের মধ্যে রয়েছে স্বচ্ছ পানির ফোয়ারা। প্রতিটি গার্ডেনের বাউন্ডারি সুন্দর করে ছাটা ঘন পাতার লাতাগুলোর ফেঞ্চ দিয়ে তৈরী। আঁকাবাঁকা পায়ে চলা পথের মাঝে মাঝে আকাশ ছোয়া দেবদারু গাছ ঠাই দাড়িয়ে আছে প্রহরীর মতো।                 এখানকার সৌন্দর্য বর্ধনের আরো একটি উপকরণ হলো অনতি দুরের সাজানো আয়তাকার এ বাগান। এখানে রয়েছে প্রায় দুই হাজার মাঝারি আকৃতির সেগুন গাছ। মূল ভুখন্ড থেকে একটু খানি বিচ্ছিন্নতা বাড়িয়ে দিয়েছে এর মনোমুগ্ধকরতা।                 তবে এটি শুধু সৌন্দর্য উপাদানই নয়, ক্ষুদ্র হলেও দেশের বনজ সম্পদের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশও বটে। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার রজত   জয়ন্তী৯৬ উপলক্ষে এখানে আরো নতুন কয়েকটি ভাস্কর্য ও স্থাপিত হয়েছে।                 উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্রভূমির এই স্বপ্নপুরীতে আসেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ভ্রমণ বিলাসীরা। এখানে ব্যবস্থাপনার কোনো ত্রুটি নেই। জেনারেল ম্যানেজার হরেন্দ্রনাথ সরকার ও মালিক নিজেই সার্বক্ষণিক ভাবে এর দেখা শোনা ও তত্ত্বাবধান করেন। এখানে লোকজনের ব্যবহার্য পানি ও গোসলের জন্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি নলকূপ, টয়লেট, গোসলখানা এবং ট্যাপের পানির ব্যবস্থা। কারো আকস্মিক অসুস্থ্যতায় ঔষধ ও চিকিৎসার ব্যবস্থাও করেন কর্তৃপক্ষ।                 এছাড়া রয়েছে একটি ফিশারি প্রকল্প। এতে উৎপাদিত মাছ অর্থনৈতিক আনুকূল্যের সঙ্গে সঙ্গে চমৎকার ও দর্শণীয়। রয়েছে একটি শপিং কমপ্লেক্স। এর দোকান ও রেস্তোরা গুলোতে পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরণের খাবার, পানীয় এবং সৌখিন কারুশিল্প দ্রব্য সমূহ। কোথায় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কোথায় কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমন কারো অনেকেই বিমুর্ত বিশাল মূর্তি স্থাপিত রয়েছে। এক প্রান্তে লেকের কোল ঘেষে তৈরী মন্ডপ আকৃতির ছোট রেষ্ট কর্ণার। যার দেয়াল জুড়ে ভেতরে ও বাহিরে আবহমান বাংলার দৃশ্য বি¯তৃত রয়েছে। তবে এই সব জয়পুরহাটের এক তরুণ কৃতী কারুশিল্পী এ কে আজাদ মনন সিমেন্ট টাইল্স ও রডের দ্বারা কাজ করেছে। একখানে লেকের পাড়ে ঘাড়মুড়ি গুজে বসে থাকা অবসন্ন কৃষকের মুর্তি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এখানে রয়েছে কয়েকটি পুকুর যা মাছ চাষ করা হচ্ছে। এখানে একটি রয়েছে ঝিনুকের দোকান যাতে সব সময় ক্রেতাদের ভীড় দেখা যায়। দোকানে আসলে মনে হয় যে, কক্সবাজার বা চট্টগ্রাম সমুদ্র সৈকতে এ ঝিনুক কিনছি। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য রয়েছে খোলা মঞ্চ, নামাজ পড়ার পৃথক অংগন। এক প্রান্তে তৈরী হচ্ছে বিরাট টিলা।                 এছাড়া ও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের ম্যুরাল তৈরী করা হয়েছে দেয়ালে দেয়ালে।                 এই স্বপ্নপুরী বিনোদন কেন্দ্র ও পিকনিক কর্ণারটি ইতিমধ্যেই উত্তরাঞ্চলের বিনোদন এবং ভ্রমন প্রেমিদের পাশাপাশি সারা দেশবাসীর কাছে অত্যন্ত প্রিয়। সারা বছর জুড়েই হাজার হাজার মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে আসে পিকনিকসহ বিনোদনের জন্য। তবে শীত মৌসুম শুরু হবার সাথে সাথেই বিনোদন প্রেমিদের আগমন বেড়ে যায় কয়েক গুণ বেশী। বিনোদন কেন্দ্র ুস্বপ্নপুরীক্যাম্পাসে বাস ৫০০/- টাকা, মাইক্রো বা কার ২০০/- টাকা। মোটর সাইকেল ৪০/- টাকা, রিক্শা ভ্যান ২০/- টাকা, বাই সাইকেল ১০/- টাকা এবং জনপ্রতি ৫/- টাকা। এতে যা আয় তা দিয়েই এখানে কর্মরত কর্মচারীদের বেতন-ভাতা মিটিয়ে বাকী যা থাকে তা দিয়ে বিনোদন কেন্দ্রের সম্প্রসারণ, সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করা হয়। এখানে আগত মেহমানদের রাত্রী যাপনের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে বাংলো। ২৪ ঘন্টার জন্য এ বাংলোগুলোর ভাড়া নীলপড়ী ডাবল রুম ৩০০/- টাকা, রজনীগন্ধা ডাবল রুম ৪০০/- টাকা। নিশিপদ্ম তিনি রুমসহ ডাবল রুম এসি ও নন এসি মোঃ দেলোয়ার হোসেন জানান, স্বপ্নপুরীকে বিনোদন প্রিয়দের কাছে স্বপ্নের মতো সাজানোর পরিকল্পনা দীর্ঘ মেয়াদি। সেই পরিকল্পনাকে সামনে রেখেই কাজ করে যাচ্ছেন বিরামহীনভবে। ভবিষ্যতে পর্যটন সুবিধা দিতে আধুনিক হোটেল, চাইনিজ রেষ্টুরেন্ট, মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে স্বতন্ত্র্য স্পট। পাখির রাজ্য, মাছের রাজ্য, রেলকার ও রোপকার প্রভৃতি তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। এ পর্যন্ত এখানে ২৫টির বেশী ছায়াছবির স্যুটিং হয়েছে। এছাড়াও দেশের বেশ কজন বর্তমান ও সাবেক মন্ত্রী, কূটনীতিক, বিচারপতি, বুদ্ধিজীবি, সাংবাদিক, উগান্ডার অর্থমন্ত্রীসহ দেশ-বিদেশের বরেণ্য ব্যক্তিরা এই স্বপ্নপুরী ঘুরে গেছেন। ব্যক্তি উদ্যোগ গড়ে উঠা এই স্বপ্নপুরীকে স্বপ্নের মতো সাজানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন নিরন্তর।                 ভৌগলিক অবস্থানরত ভাবে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প সোনালী সম্ভাবনাময় এবং বিগত কয়েক বছর এ শিল্পের যথেষ্ট উন্নতি ও অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। পর্যটন কর্পোরেশনের শুভ এর সদয় দৃষ্টি পেলে উত্তরবঙ্গের অবহেলিত এই স্বপ্নপুরী পিকনিক কর্ণারটি একদিন দেশবাসীর কাছে সত্যিকারের স্বপ্নপুরীতে পরিণত হবে।



শেয়ার করুন

0 facebook: